ডা. জাহেদ উর রহমান :
‘Make America Great Again’-সদ্য নির্বাচনে পরাজিত হওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় খুবই সফলভাবে এ স্লোগানটি ব্যবহার করেছিলেন। স্লোগানটি অবশ্য একেবারে তার অভিনব কোনো আবিষ্কার নয়। চার দশক আগে ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রোনাল্ড রিগ্যান এ স্লোগানটির শুরুতে ‘Let’s’ যুক্ত করে ব্যবহার করেছিলেন। তারপর ১৯৯২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বিল ক্লিনটনও একই স্লোগান ব্যবহার করেন। এমনকি এর পর তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য তৈরি হওয়া একটি টিভি বিজ্ঞাপনেও এ স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
আলোচিত স্লোগানটিতে ‘again’ শব্দটি থাকার মানে হচ্ছে, যারা এ স্লোগানটি ব্যবহার করছেন, তাদের বিবেচনায় অন্তত সেই সময়ের আমেরিকা ‘great’ ছিল না। ক্ষমতাসীন নন, এমন কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য এটি একটি মোক্ষম স্লোগান তো বটেই। সর্বসাম্প্রতিক ব্যবহারটা যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্প করেছেন, আমরা একটু দেখার চেষ্টা করি, তিনি আমেরিকাকে কি আসলে গ্রেট করতে পেরেছেন? এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, গ্রেট বলতে আর সবাই যা বুঝিয়েছিলেন, ট্রাম্পও কি সেটাই বুঝিয়েছেন? ট্রাম্প কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটা হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারেন, তার ব্যবহৃত আরেকটা ‘america first’ স্লোগানটিও তিনি প্রথম ব্যবহার করেননি। তবে এ স্লোগান আমেরিকা তার দেশের বাইরের অন্য সবকিছুর প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দিয়ে নিজের দিকে বেশি দৃষ্টি দেয়ার কথা বলে।
মজার ব্যাপার, আগে দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময় এ স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছিল, তখন সংকটের মুখে থাকা একটি দেশ নিজের দিকেই সবার আগে দৃষ্টি দেবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ট্রাম্প এমন সময় এ স্লোগান ব্যবহার করেছেন, যখন কোনো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। তাহলে প্রশ্ন আসে, অন্যদিকে মনোযোগ কমিয়ে দিয়ে আমেরিকাকে কি গ্রেট বানানো সম্ভব ছিল?
আমরা পছন্দ করি বা না-করি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত ১০০ বছর পৃথিবী সব সময় এক বা একাধিক দেশের নেতৃত্ব দেয়া বিশ্বব্যবস্থায় চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল মূলত আমেরিকার হাতে বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব চলে আসার সময়। বেশ কয়েক বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন সে ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারলেও সোভিয়েতের পতনের পর আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিশ্বব্যবস্থায় তৈরি হয়েছিল। বলা বাহুল্য, কারও নেতৃত্বে কোনো বিশ্বব্যবস্থা কখনও চিরন্তন কোনো বিষয় নয়; এর পালাবদল ঘটে। নেতৃত্বদানকারী শক্তিটি ধীরে ধীরে নানা দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উঠতি আরেকটি শক্তি সেই স্থান দখল করে নেয়। অনেক ক্ষেত্রেই সেই দুটি শক্তি যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে। গ্রাহাম এলিসন যাকে ‘থুসিডিডিস’স ট্র্যাপ’ নাম দিয়েছেন।
গত কয়েক বছর থেকে বিশেষ করে, শি জিনপিং চীনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমেরিকার নেতৃত্ব বিশ্বব্যবস্থায় আদৌ টিকে থাকবে কি না বা টিকে থাকলেও কতটা প্রভাবশালী থাকবে-সেটার প্রতি এক শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে উঠতি পরাশক্তি চীন। এ চীনের সঙ্গেই নানা ক্ষেত্রে আবার খুব দৃঢ় পার্টনারশিপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাশিয়ার। এ পরিস্থিতি একটা খুব বড় যুদ্ধ বাধায় কি না, এ আশঙ্কা তো আছেই। এটি নিয়েই এলিসন লিখেছেন অতি আলোচিত ‘Destined for War: Can America and China Escape Thucydides’s Trap?’ বইটি।
এ লেখা যখন লিখছি, তখন এটি প্রায় শতভাগ নিশ্চিত, জো বাইডেনই হতে যাচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প উদ্ভট ধরনের কোনো জটিলতা তৈরি করতে সফল না হলে তিনি আর প্রেসিডেন্ট থাকছেন না। হ্যাঁ, ট্রাম্প পরাজিত হয়েছেন; কিন্তু আমরা এরইমধ্যে খেয়াল করেছি রাশিয়া এবং চীন ট্রাম্পের পরাজয়কে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি; তাই জো বাইডেনকে অভিনন্দনও জানায়নি তারা। এর সঙ্গে আমরা মিলিয়ে দেখতে পারি ২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার কিছুদিন পরের একটি ঘটনা। মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য রাশিয়ান হ্যাকাররা সামাজিক মাধ্যমে নানা রকম ফেক নিউজ ছড়িয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে-এমন অভিযোগ বেশ শক্তভাবেই উঠেছিল। অর্থাৎ রাশিয়া মরিয়াভাবে চেয়েছিল ট্রাম্প ক্ষমতায় আসুক। ভাবতেই ব্যাপারটায় খটকা লাগা খুব স্বাভাবিক। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পেয়েছি এটা তারা কেন চেয়েছিলেন।
যুদ্ধাবস্থা না থাকলেও আমেরিকা পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অন্য অনেক ক্ষেত্র থেকে নিজকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরিয়ে নিয়েছিল। বলা বাহুল্য, অ্যারিস্টটলের বিখ্যাত উক্তি ‘প্রকৃতি শূন্যতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে’ শুধু পদার্থবিদ্যায় নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বরং আরও বেশি প্রযোজ্য। সেই শূন্যস্থানগুলো দখল করে নিয়েছে মূলত চীন এবং কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়া। এর একটা খুব বড় প্রমাণ হতে পারে এ তথ্যটি-জাতিসংঘের বিশেষায়িত ২০টি সংস্থার মধ্যে মাত্র দুটির প্রধান এখন মার্কিনি আর পাঁচটির প্রধান চীনা নাগরিক।
ট্রাম্প আমেরিকাকে সরিয়ে নিয়েছেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনেস্কো, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি, এশিয়ার বেশকিছু দেশের সঙ্গে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি থেকে। এমনকি আমেরিকাকে তিনি ন্যাটো থেকে বের করে আনার কথাও বেশ কয়েকবার বলেছিলেন। ইউরোপে সৈন্যসংখ্যা কমিয়েছেন তিনি; এমনকি আমেরিকার অতি গুরুত্বপূর্ণ দুই মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে সৈন্য রাখার জন্য দ্বিগুণ বা চতুর্গুণ খরচ দাবি করেছিলেন।
শুধু নিজের দেশের ক্ষেত্রেই নয়, তিনি যে কোনো বহুপাক্ষিক বিষয়ের বিরোধী ছিলেন। এ কারণেই তিনি প্রকাশ্যে ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে কথা বলেছেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, ট্রাম্প আমেরিকার গ্রেটনেস বরং অনেক কমিয়েছেন।
জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ট্রাম্প আগে বৈশ্বিক এবং বহুপাক্ষিক যেসব বিষয় থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে এনেছেন, তিনি সেই জায়গাটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই প্রচারণার সময় এবং নির্বাচনে জিতেও তিনি তার প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বাইডেনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অফিশিয়াল ওয়েবসাইটটি ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখলাম সেখানে তার ফরেন পলিসির ক্ষেত্রে টাইটেল দিয়েছেন-‘Restore American Leadership Abroad.’
আমাদের ভালো লাগুক বা খারাপ, জো বাইডেন তার ক্ষমতার সময়টায় এ কাজটি করবেন। এরইমধ্যে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কী করতে পারেন কিংবা পূর্ব এশিয়ায় তার পদক্ষেপ কী হতে পারে-এসব কিছু নিয়ে নানারকম বিশ্লেষণ আমাদের দিয়েছেন। আমি ওদিকটায় আর খুব বেশি যাচ্ছি না। কিন্তু জো বাইডেনের এবারকার নির্বাচনী প্রচারণার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সম্ভবত তার লিবারেল ডেমোক্রেসির প্রতি অটুট শ্রদ্ধা এবং আস্থা।
বাইডেনকে ধন্যবাদ, তিনি ট্রাম্পের গতবারের বিজয়ের পরও অন্য অনেক উদার গণতান্ত্রিক নেতার মতো ভুল করেননি। তিনি নিজেও কোনো নরম ধরনের পরিচয়বাদী রাজনীতির পথ মাড়াননি। তিনি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এবং সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয় নিয়ে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় এবং নির্বাচনে জেতার পর তিনি পরিচয়বাদী রাজনীতিবিদদের উল্টোপথে গিয়ে বিভেদ নয়, পুরো আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি সেই চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এখানে খুব উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, বাইডেনের এ প্রতিশ্রুতি শুধু তারা দেশের জন্য নয়, তিনি উদার গণতন্ত্রকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চান। তার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হচ্ছে-ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরেই একটি ‘বিশ্ব গণতন্ত্র সম্মেলন’ আয়োজন করবেন। এ সম্মেলন সম্পর্কে নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি বেশকিছু কথা বলেছেন, তবে এ লেখার কলেবর সীমিত রাখার স্বার্থে অন্তত এর তিনটি ঘোষিত উদ্দেশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি: ১. স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার প্রতিরোধ করা। ২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা। ৩. সব দেশে মানবাধিকার নিশ্চিত করা। এ ছাড়াও সব দেশের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে পার্টনারশিপ তৈরি করার কথা আছে। আছে এ মুহূর্তে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো (সামাজিক মাধ্যম, যোগাযোগ অ্যাপ, সার্চ ইঞ্জিন) গণতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে ওঠে তেমন কোনো কিছু না করে সেটি নিশ্চিত করার কথা। একইসঙ্গে এটিও নিশ্চিত করার চেষ্টা হবে, এ মাধ্যমগুলো যেন মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করার সব রকম ব্যবস্থা নেয়।
পৃথিবীতে গণতন্ত্রের চলার পথ কোনোকালেই মসৃণ ছিল না। স্যামুয়েল হান্টিংটন গণতন্ত্রের প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করে আমাদের দেখিয়েছেন গণতন্ত্রের জোয়ার এবং ভাটা হয়। এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ মুহূর্তে পৃথিবী গণতন্ত্র একটা ভাটার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০০৬ সালের পর থেকে পৃথিবীতে কার্যকর গণতন্ত্রের দেশের সংখ্যা প্রতিবছর কমেছে। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না ইকোনমিস্ট পত্রিকার ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের সর্বশেষ রিপোর্টে আমেরিকা পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়নি, তার নাম আছে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ ক্যাটাগরিতে। জো বাইডেন যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যাচ্ছেন, সেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে আশা করা যায়, এ প্রবণতার একটা উল্টোযাত্রা আমেরিকায় তো শুরু হবেই; সঙ্গে সেটি ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী।
চীনের নেতৃত্বাধীন (সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাশিয়ান পার্টনারশিপসহ) বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হওয়ার পথে মূল বাধা তৈরি করা সম্ভব এ দুটি দেশের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীত ব্যবস্থা পৃথিবীতে রক্ষা এবং বিকশিত করার মাধ্যমে-এ বাস্তবতা জো বাইডেন খুব ভালোমতো বুঝতে পেরেছেন। কোনো সন্দেহ নেই, পৃথিবীতে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করা আমেরিকার কোনো চ্যারিটি না-এটা তারা করবে তাদের হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার স্বার্থেই। কিন্তু এ চেষ্টা পৃথিবীর বহু দেশে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর জন্য এক বড় অশনিসংকেত তৈরি করতে যাচ্ছে, এটা দৃঢ়ভাবেই বলা যায়।
কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর জন্য যে কোনো রকম অশনিসংকেত নিশ্চিতভাবেই উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা মানুষগুলোর জন্য এক বিরাট সুখবর। এ পরিস্থিতি শক্তিশালী হতে শুরু করলে সেই মানুষগুলো ভীষণ খুশি হবেন; যারা বিশ্বাস করেন, মানুষ কোনো নীচু শ্রেণির প্রাণীর মতো শুধু খাবার, আশ্রয় পেলেই সন্তুষ্ট থাকে না, তার আরও বেশকিছু চাহিদা থাকে-সে কথা বলতে চায়, সে ভোটের মাধ্যমে তার সরকার নির্বাচন করতে চায়, সে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করতে চায়, প্রয়োজনে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে চায়, সে রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার চায়, সে মানবাধিকার চায়।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট